Description

জামেয়া কাসেমিয়া: ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পূর্ব কথা:
পৃথিবীতে মানুষকে পাঠানো হয়েছে মহান রাব্বুল আলামীনের খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি হিসেবে। তার প্রতিনিধিত্ব করার  জন্যে প্রথম শর্ত তাঁকে জানা, তাঁর মহিমা, একত্ববাদ ও সীমাহীন ক্ষমতার বলয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা। আর এজন্যে প্রয়োজন শিক্ষার। শিক্ষা ছাড়া মানুষ যেমন নিজেকে জানতে পারেনা, তেমনি পারে না তার রবকে চিনতে। শিক্ষার দ্বারা মানুষ আলোকিত হয়, সত্য সুন্দরের পথ প্রাপ্ত হয়, শাশ্বত মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়। মানব জীবনে শিক্ষার এই অপরিহার্যতাকে আমরা উপলদ্ধি করতে পারি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্মরণীয় বাণী থেকে: ‘বিদ্বানের কলমের কালি, শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান’। কিংবা ‘মুসলিম নর-নারী প্রত্যেকের ওপর জ্ঞান অর্জন অবশ্য কর্তব্য’। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম নির্দেশই ছিল ‘ইকরা’ অর্থ্যাৎ ‘পড়’, (পড় তোমার প্রভুর নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন) এই নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সরাসরি মানুষকে শিক্ষা অর্জন করতে বললেন। যে শিক্ষা উপকারী, কল্যাণময়, সত্য সুন্দরের পথে চলার সহায়ক; মূলত সেই শিক্ষা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে কোরআন ও হাদীসে। ইবলিশ যাকে আমরা শয়তান বলে ডাকি, তার শিক্ষা তাকে বিপদগামী করেছে, বিভ্রান্ত করেছে। তার সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞান-প্রজ্ঞা কোন কাজে আসল না। আবু জাহেলকে আরবের মানুষেরা আবুল হাকাম (অর্থাৎ বিজ্ঞদের পিতা) বলে জানতো। কিন্তু ওহী লদ্ধ জ্ঞান না থাকায় বা এ জ্ঞানকে ধারণ করার মানসিকতা না থাকায় ইসলাম পরবর্তী যুগে আবুল হাকামে সম্বোধিত হল আবু জাহেল বলে। অপরদিকে হযরত আদম (আঃ) কে শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত করার জন্যে আল্লাহ তাঁতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। উম্মী নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে জিব্রাইলের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। যেন তিনি বিভ্রান্ত জাতিকে সত্য পথের দিশা দিতে পারেন। অতএব শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। মানুষকে বলা হয় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। এই শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র জ্ঞানের মাধ্যমে, শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
শিক্ষাকে প্রধানত দু’ভাগে বিশ্লেষিত করা যায়। প্রথমতঃ বৈষয়িক শিক্ষা, দ্বিতীয়তঃ নৈতিক তথা ইসলামী শিক্ষা। বৈষয়িক শিক্ষা মানুষকে কেবল ভোগ পিয়াসী করে তোলে, আখেরাত সম্পর্কে ঔদাসীন্য করে পার্থিব জীবনকে মোহনীয় করে তোলে এবং ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার দিকে সর্বোতভাবে প্ররোচিত করে। অপর দিকে নৈতিক তথা ইসলামী শিক্ষার মৌল চেতনা হচ্ছে আখেরাতমুখী, পরকালের জবাবদিহীর চেতনা সম্পন্ন। ইসলামী শিক্ষা মানুষকে ভোগ পিপাসু না করে ত্যাগী বানায়, পার্থিব জীবনই মুখ্য এবং শেষ নয় বরং মৃত্যুর পর অনন্ত জীবন অপেক্ষমান - এই বোধ জাগ্রত করে। ইসলামী শিক্ষা একজন মানুষকে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন করে আদর্শ নাগরিক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কর্মনিষ্ঠ, সময় সচেতন, আতœনির্ভরশীল ও আতœবিশ্বাসী হতে অনুপ্রাণিত করে ইসলামী শিক্ষা। ইসলামী শিক্ষা মানে সমন্বিত শিক্ষা- কোরান হাদিসের পাশাপাশি বৈষয়িক ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের সমন্বিত শিক্ষা। যার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাত সবখানে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
বর্তমান সমাজে ইসলামী বা ধর্মীয় শিক্ষা বলতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে বুঝানো হয়ে থাকে। ইতিহাসের পাতায় চোখ মেলে দেখতে পাই ইসলামী শিক্ষার প্রথম রূপকার হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। বর্তমানে যে মাদ্রাসা- মক্তব শিক্ষা প্রচলিত আছে তার যাত্রা শুরু হয় মহানবীর আমল থেকেই। সে সময় সত্যান্বেষী মানুষেরা তাঁর কাছে ভিড় জমাতেন ও’হী বা আল্লাহর বাণীকে শেখার জন্যে, দৈনন্দিন জীবনের গøানি মুক্ত হয়ে রাসূলের (সাঃ) জীবনধারাকে অবলোকন করার জন্যে। ঐক্ষেত্রে আসহাব সফফার কথা উল্লেখ করা যায়। মসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের (সাঃ) নিকট দীক্ষা নিতেন, শিক্ষা গ্রহন করতেন। এই আসহাবে সাফফার অন্যতম শিক্ষার্থী ছিলেন হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ), হযরত বেলাল (রাঃ) হযরত শোয়াইব (রাঃ), হযরত আম্মার (রাঃ) প্রমুখ। এখানে তাঁরা রাসূলের (সাঃ) নিকট থেকে যে শিক্ষা পেতেন, সেই শিক্ষা দূর দূরান্তে যেয়ে প্রচার করতেন। তবে ইতিহাসের পাতায় আমরা ‘দ্বারে আরকাম’ নামক এক শিক্ষায়তনের কথা জানতে পারি। রাসূলের মক্কী জীবনে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বারে আরকামে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) ছাড়াও আশরায়ে মুবাশশিরার প্রায় সবাই গোপনে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে জ্ঞান অর্জন করতেন। এই দ্বারে আরকামকে ‘প্রথম মাদ্রাসা’ বলে অভিহিত করা যায়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন প্রসার ঘটার প্রেক্ষিতে মসজিদের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষার জন্যে পৃথক স্থান বেছে নিতে হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ১৯০ হিজরীর কথা এসে যায়। এ সময় সিরিয়াতে ‘আল মাদরাসাতুস সাদিরিয়া’ নামে একটি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। এভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটে। প্রসঙ্গত আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলতে হয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় থেকে ভারত উপমহাদেশে আরব বণিকদের আনাগোনা শুরু হয় এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরী হয়ে যায়। ১২০৪ খ্রীঃ ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা ‘লক্ষণ সেনকে’ বিতাড়িত করে এখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
কয়েক শতাব্দী কালের মুসলিম শাসনামলে এদেশে মুসলমানদের সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল দক্ষ ও আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা। মুসলমানরা এদেশে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব সাধন করেন। ১৮৮২ সালে ইংরেজদের এক শিক্ষা কমিশন রিপার্টে উল্লেখ করা হয়েছে-
“আর সব মুসলিম দেশের মতই ভারত বর্ষে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের পর তাঁরা তাদের মসজিদগুলোকে শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করে। ধর্মই তাদের শিক্ষার বুনিয়াদ হবার কারণে এসব শিক্ষা কেন্দ্রের জন্যে সরকারকে তেমন ব্যয়ভার বহন করতে হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াকফ ও উইলের সম্পত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। দ্বীনদার লোকেরা পরোলৌকিক পুণ্য লাভের জন্য ওয়াকফ এবং সম্পত্তি প্রদানের অসিয়ত করে যায়। পাক ভারতীয় মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্রাসার এ অবস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল পর্যন্ত বলবত থাকে।”
এ রিপোর্ট থেকে মুসলমানদের মাদ্রাসা পরিচালনার একটা চিত্র আমরা বুঝতে পারি। আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে  এদেশে সর্বপ্রথম কখন এবং কোথায় মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল তা সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। অবশ্য আবুল কাসেম মাহমুদের শাসনামলে এদেশে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন।
ঐতিহাসিক প্রফেসর সাইয়্যেদ মুহাম্মদ সলীম উল্লেখ করেছেন, “৫৮৯ হিজরী মোতাবেক ১১৯২ খ্রীস্টাব্দে হিন্দুস্থানে মুয়েযুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে সাম (শিহাবুদ্দীন গোরী নামে খ্যাত) কর্তৃক ইসলামী হুকুমাত কায়েম হয়। তার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে রাজ্যের চতুর্দিকে শিক্ষা দীক্ষার চর্চা ছড়িয়ে পড়ে। এ জ্ঞান প্রিয় বাদশাই সর্ব প্রথম দিল্লীতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাদশার নাম অনুযায়ী এ মাদ্রাসার নামকরণ করা হয়, ‘মাদরাসায়ে মুয়েযীয়া’। পরবর্তী বাদশাহ কুতুব উদ্দীন আইবেক (১২০৬-১২১২ খ্রীঃ) আজমীরে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্রাসাকে ‘আড়াই দিনের ঝুপড়ি’ বলা হত। তৃতীয় মাদ্রাসাটি মুলতান ও উচের শাসনকর্তা নাসীরুদ্দীন কুবাচা ‘উচে’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাজী মিনহাজুদ্দীন সিরাজ জুরজানী (মৃত্যু ১২০৬ খ্রীঃ) সর্ব প্রথম উচের মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োজিত হন। পরে তিনি মাদরাসায়ে মুয়েযীয়ার প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি হন।
এভাবে মুসলিম শাসক আর ওলামায়ে দ্বীন ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ চেষ্টা সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সারা ভারত বর্ষে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটে। এক ঐতিহাসিক বলেছেন, সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকের (১৩২৫-৫১ খ্রীঃ) আমলে এক হাজার মাদ্রাসা ছিল। এর মধ্যে শাফেয়ী মাযহাবের লোকদের একটা মাদ্রাসা ছিল। শিক্ষকদের সরকারী কোষাগার থেকে ভাতা প্রদান করা হতো মাদরাসাগুলোতে দ্বীনী শিক্ষার সাথে সাথে গণিত এবং দর্শন শাস্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হতো। রোহিলাখন্ডের হাফেজুল মুলক নওয়াব রহমত আলী খানের (মৃত্যুঃ ১৭৭৪ খ্রীঃ) জীবন চরিতে উল্লেখ আছে: “দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ার পরও কেবল মাত্র রোহিলা খন্ড জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঁচ হাজার আলেম শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত ছিলেন। হাফেজুর মুলক নওয়াব রহমত আলী খানের কোষাগার থেকে তারা নিয়মিত ভাতা পেতেন। কোলকাতা, দেওবন্দ মাদ্রাসা ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সন্দেহ নেই।” এস, বসুর এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, “ইংরেজ শাসনের পূর্বে কেবলমাত্র বাংলাদেশেই আশি হাজার মক্তব ছিল।” (ম্যাকস মুলাবের শিক্ষা রিপোর্ট)। বাংলাদেশে যে সব মাদ্রাসা প্রথম দিকে স্থাপিত হয় তার মধ্যে হাট হাজারী মাদ্রাসা, পুটিয়া মাদ্রাসা, ঢাকা লালবাগ মাদ্রাসা, মাদ্রাসা এ আলিয়া- ঢাকা উল্লেখযোগ্য। এসব মাদ্রাসা থেকে অগণিত শিক্ষার্থী জ্ঞান পিপাসা নিবৃত করে সমাজ গঠনে আতœনিয়োগ করেছেন।
জামেয়া প্রতিষ্ঠার গোড়ার কথা:
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাদী আদর্শ ইসলামী শিক্ষায়তন জামেয়া কাসেমিয়া, নরসিংদী (গাবতলী মাদ্রাসা) আজ স্বনামধন্য সুপরিচিত একটি দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মেঘনা বিধৌত নরসিংদী সদর থানার অন্তর্গত পুরান পাড়া এলাকায় ১৪ একর জমির উপর স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে নিরেট তাওহীদ চর্চার প্রাণ কেন্দ্র জামেয়া কাসেমিয়া। কালের স্বাক্ষী হিসেবে এখানে রয়েছে সুদৃশ্য সুবিশাল এক গাবগাছ। এ গাবগাছের নামানুসারে নুতন গড়ে ওঠা এলাকা (মাদ্রাসা সংলগ্ন) পরিচিতি অর্জন করেছে ‘গাবতলী’ বলে। আর স্থানীয় শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষের কাছে জামেয়া কাসেমিয়া ‘গাবতলী মাদ্রাসা’ বলেই পরিচিত। আজ জামেয়া কাসেমিয়ায় রয়েছে সুবিশাল মনোরম একাডেমিক ভবন, রয়েছে সুদৃশ্য ছাত্রবাসসমূহ, বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। বায়তুল মুকাদ্দাসের আকৃতি বিশিষ্ট স্থাপত্য শিল্পের অপরূপ নিদর্শন জামেয়া মসজিদ কমপ্লেক্সসহ বিশাল ক্যাম্পাস। ১৯৭৬ সালে সময়ের স্বাক্ষী রূপকথার নায়ক গাবগাছটি ছাড়া এ সবের কিছুই ছিল না। ছিল গা হিম করা শীতলতা এবং এক ভৌতিক পরিবেশ।
১৯৭৬ সালের ১লা জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে পথ চলা শুরু করে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী সেদিন হয়েছিলেন নতুন প্রতিষ্ঠানের কাÐারী। সেই যে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি জামেয়া কাসেমিয়ার (গাবতলী মাদ্রাসা) হাল ধরেছিলেন, আজো সে তরী বেয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। জামেয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের আগে প্রস্তুতি পর্বে কেটে যায় দীর্ঘদিন। বাংলা ১৩৮০ পৌষ মাসের ২৩ তারিখে নরসিংদী সদরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সমবেত হন ব্রাহ্মন্দী জামে মসজিদে। সবার মনে প্রাণে দুলছে নতুন একটি স্বপ্ন, মোহন এক আবেশ। অত্র এলাকার জনসাধারণকে আলোক পথের সন্ধান দেবার জন্যে, বিশেষত নিজেদের সন্তানদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দুর্নিবার আকাক্সক্ষায় সবাই উন্মুুখ। কারণ নরসিংদী জেলায় রায়পুরা, শিবপুর, মনোহরদী সহ অন্যান্য এলাকায় অনেক আগ থেকে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলেও নরসিংদী শহরের বা তদসংলগ্ন জনপদে এই দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের অভাব বিদ্যমান। এখানে উলে­খ্য, ১৯২৭ সালে শিবপুরের কুমরাদি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কুমরাদি সিনিয়র মাদ্রাসা। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আব্দুল আজীজ সাহেব। তিনি রায়পুরা এলাকার চরসুবুদ্দি সিনিয়র মাদ্রাসায় পাঠ শেষ করে এ মাদ্রাসার ভিত রচনা করেন। ১৯৪৯ সালে ইছাখালী সিনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। কাছাকাছি সময়ে মনোহরদী এলাকাতেও বেশ কিছু মাদ্রাসা স্থাপিত হয়।
নরসিংদী সদরের সচেতন জনগণ একটা আদর্শ মাদ্রাসার অভাব বোধ করে সেদিন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারই ফলশ্রæতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জামেয়া কাসেমিয়ার মত আদর্শ বিদ্যাপীঠ। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেদিন সর্ব জনাব রুস্তম আলী আশরাফি, আসহাব উদ্দীন ভূঁইয়া (মধু ভূঁইয়া), মৌলানা মোঃ জালাল উদ্দীন, আব্দুর রহমান ভূঁইয়া সহ প্রায় পঞ্চাশ সুধিজন একত্রিত হয়েছিলেন। হাকিম রুস্তম আলী সাহেব এই প্রস্তুতি সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভায় প্রস্তাবিত মাদ্রাসার জন্যে পুরানপাড়ার আছহাব উদ্দিন ভূঞা (মধু ভূঞা) ১০ গন্ডা জমি এই মর্মে ওয়াক্ফ করে দিতে সম্মত হলেন যে দানকৃত জমিতে এমন একটি আদর্শ আবাসিক দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেখানে আল্লাহর দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা অর্থ্যাৎ কোরান-হাদিসের শিক্ষার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার সুব্যবস্থা থাকবে। যাতে এই প্রতিষ্ঠান হতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রবৃন্দ কর্মজীবনে সরকারী বেসরকারী তথা সমাজের সর্বস্তরে নিয়োজিত হতে পারে। এ সভায় তায়েব উদ্দীন ভূঁঞার প্রস্তাব অনুসারে প্রস্তাবিত মাদ্রাসার জন্যে অর্থ কালেকশান আর আনুষাঙ্গিক কার্যাদি পরিচালনার জন্যে একটি অরগানাইজিং কমিটি গঠিত হয়। সর্ব সম্মতিক্রমে জনাব হাকিম রুস্তম আলী আশরাফী সাহেব চেয়ারম্যান, জনাব তাফাজ্জল হোসেন ও জনাব আছহাব উদ্দীন ভূইয়া ভাইস চেয়ারম্যান এবং এ, কে, এম, জয়নাল আবেদীন সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। এ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে মৌঃ জালাল উদ্দীন, জনাব তোতা মিয়া, আব্দুর রহমান ভূঁইয়া, জনাব মোছলেহ উদ্দিন ভূঞা, শামসুদ্দিন আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। জামেয়ার অধ্যক্ষ (বর্তমান) মাওলানা কামালুদ্দীন জাফরীও এ কমিটির সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। প্রস্তাবিত মাদ্রসার চাঁদা আদায়ের জন্যে আশে পাশে ১৭টি এলাকার ১৭জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে মনোনীত করা হয়। সভায় উপস্থিত সদস্যদের মাঝ থেকে নগদ ৪৮২ টাকা আদায় হয়।  এছাড়া ১০২৩ টাকার প্রতিশ্রæতি পাওয়া যায়। ১ টাকা থেকে শুরু করে ১০০/- টাকা পর্যন্ত আদায় হয় প্রস্তাবিত মাদ্রাসার জন্যে। প্রস্তাবিত নামকরন স্থির হয় অর্গানাইজিং কমিটির ৩য় সভায় ১৯৭৪ সালের ২৭ জানুয়ারী। ব্রাহ্মন্দী জামে মসজিদে (বায়তুল আমান) অনুষ্ঠিত সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরীর প্রস্তাব অনুসারে সর্বসম্মতিক্রমে “জামেয়া ই কাসেমিয়া” গৃহীত হয়। রাসূল (সাঃ) এর বাণী ‘ইন্নামা আনা কাসিমুন, ওয়াল­াহু ইউতি’ অনুসারে এ নামকরণ করা হয়। এদিন মাদ্রাসার প্রচার ও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে সাধারণ সভার আয়োজনের প্রস্তাব দেয়া হয় এবং ওলামায়ে কেরামকে দাওয়াত দানের দায়িত্ব অর্পিত হয় মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী সাহেবের উপর। প্রথম জামেয়াতে বসে কমিটির অষ্টম অধিবেশন ১৪ ই আষাঢ় ১৩৮২ (বাংলা)। হাকীম রস্তম আলী আশরাফীর সভাপতিত্বে এ সভার কাজ শুরু হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৌঃ তাফাজ্জল হোসেন। প্রধান অতিথির প্রস্তাবানুসারে এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় জামেয়ার চারপাশের জমির উৎপাদিত ফসল কানি প্রতি এক কাঠা ধান মাদ্রসাকে দিতে হবে।
হাকীম রুস্তম আলী আশরাফী সাহেবের সভাপতিত্বে ৪ঠা আগস্ট ১৯৭৫ সালে সাংগঠনিক কমিটির সভায় কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঐদিন প্রস্তাবিত ৬০ হাত দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি টিনের ঘর নির্মাণের জন্যে, ‘গৃহ নির্মাণ কমিটি’ গঠিত হয়। ৭ সদস্য বিশিষ্ট গৃহ নির্মাণ কমিটির সদস্যরা হলেন সর্ব জনাব শমসের আলী, শামসুদ্দীন ভূঁঞা, এ, কে, এম, জয়নুল আবেদীন, আব্দুর রহমান ভূঁঞা, সাহাবুদ্দীন মিয়া, আছহাবুদ্দীন ভূইয়া এবং মোঃ বদরুজ্জামান।
৪ঠা আগষ্টের সাংগঠনিক সভায় তৎকালীন সেক্রেটারী জনাব মাওলানা জালালুদ্দীন সাহেব বিভিন্ন কর্মব্যস্ততার দরুণ সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালনে অমত প্রকাশ করলে জনাব মাস্টার বশিরুদ্দীন মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী সাহেবকে সেক্রেটারী করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার প্রস্তাবের প্রতি জনাব শমসের আলী সাহেব সমর্থন জ্ঞাপন করলে সর্বসম্মতিক্রমে জনাব জাফরীকে সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, নবনিযুক্ত সেক্রেটারী যেন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার যাবতীয় কর্মকান্ডে নিজেকে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত রাখেন। সে দাবী সভার পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়। সাথে সাথে সেক্রেটারীর পারিবারিক খরচ নির্বাহের জন্যে মাসিক ৪০০/= টাকা ভাতা নির্ধারণ করা হয়। জনাব আছহাবুদ্দীন ভূঁইয়া সর্বশেষ এই প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন। সহকারী সেক্রেটারী হিসেবে মাওলানা জয়নুল আবেদীনকে মনোনীত করা হয়।
১৮ জুলাই ১৯৭৬ সালে জনাব হাকীম রুস্তম আলী আশরাফী সাহেবের সভাপতিত্বে জামেয়া কাসেমিয়া, সাংগঠনিক কমিটির এক অধিবেশন জামেয়া প্রাঙ্গনে গাবতলায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সেক্রেটারী মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরীর প্রস্তাবানুসারে জামেয়ার জন্যে নিম্নবর্ণিত স্টাফ মনোনীত হল:
১. জনাব মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী         অধ্যক্ষ    ৪০০/-
২. জনাব মাওলানা হাফেজ মোঃ ফয়জুল্লাহ                 উপাধ্যক্ষ  ৫০০/-
৩. জনাব মাওলানা আবুল হাশেম (হাজী হুজুর)           শিক্ষক    ৪০০/-
৪. জনাব মাওলানা আব্দুর রশীদ                              শিক্ষক    ২৫০/-
৫. জনাব মাওলানা আমীনুল ইসলাম                         শিক্ষক    ২৫০/-
৬. জনাব মাওলানা ক্বারী আবুল হাশেম                     শিক্ষক    ১৫০/-
৭. মোঃ আব্দুল করীম                                             বাবুর্চি     ১০০/-
উল্লেখ্য উপর্যুক্ত স্টাফবৃন্দের নিয়োগপত্র ৫ জুলাই ১৯৭৬ ইং হতে প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাংগঠনিক কমিটির এ সভায় জনাব মৌঃ তাফাজ্জল হোসেন শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন নির্বাহ করার জন্যে নরসিংদী বাজারের সামর্থবান ব্যবসায়ীদের উপর এমন হারে চাঁদা নির্ধারণের প্রস্তাব দেন যাতে মাসে কমপক্ষে ১০০০/- (এক হাজার) টাকা আদায় হয়। তার প্রস্তাব সমর্থন করেন আব্দুর রহমান ভূঁইয়া (এম.পি)। ইতোমধ্যে জামেয়া কাসেমিয়া উন্নয়নকে তরান্বিত করার লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী ব্যবস্থাপক কমিটি গঠনের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নিম্ন লিখিত সদস্যবৃন্দের সমন্বয়ে জামেয়ার প্রথম ম্যানেজিং কমিটি (ব্যবস্থাপনা কমিটি) গঠন করা হয়।
১. জনাব মৌঃ আব্দুল হাই সরকার (মহকুমা প্রশাসক, নারায়নগঞ্জ)               সভাপতি
২. জনাব হাকীম রস্তম আলী আশরাফী                                                   সহ-সভাপতি
৩. জনাব মৌঃ আলহাজ্ব তাফাজ্জ হোসাইন                                               সহ-সভাপতি
৪. জনাব মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী                                       সেক্রেটারী
৫. জনাব আছাবুদ্দীন ভূঁইয়া (মধু ভূইয়া)                                                সদস্য
৬. জনাব আব্দুর রহমান ভূঁইয়া (এম.পি)                                                ক্যাশিয়ার
৭. জনাব আব্দুর রহমান ভূঁইয়া (ঘোড়াদিয়া)                                           সদস্য
৮. জনাব আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া                                                           সদস্য
৯. জনাব মেজর এম এ কাশেম (চেয়ারম্যান, জবা টেক্রটাইল)                     সদস্য
উপর্যুক্ত কমিটির নেতৃত্বে জামেয়া কাসেমিয়া একটি আবাসিক আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দীপ্ত পায়ে পথ চলা শুরু করে। ৩০ নভেম্বর ১৯৭৬ জামেয়ার ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এলাকার কৃতি সন্তান বাংলাদেশ সরকারে কেবিনেট সচিব (পরবর্তীতে খাদ্য মন্ত্রী) জনাব মোঃ আঃ মোমেন খানকে মাদ্রাসা পরিদর্শনের আমন্ত্রনের কথা এবং অনতিবিলম্বে একটি প্রতিনিধিদল তার কাছে প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়।

সৌদি রাষ্ট্রদূতের আগমন:
১৯৭৮ জামেয়া ম্যানেজিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় জামেয়ার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদী আরবের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত জনাব ফুয়াদ আঃ হামিদ আল খতীবকে দাওয়াত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ৫ এপ্রিল ১৯৭৮ সম্মানিত রাষ্ট্রদূত জামেয়ায় আগমন করেন এবং জামেয়ার বার্ষিক সম্মেলণে অংশ গ্রহণ করে তিনি এদিন জামেয়া ভবনের (বাদশাহ আব্দুল আজীজ শিক্ষা ইমারত) ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। এখানে উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে মহামান্য রাষ্টপতি মেজর জিয়াউর রহমান নরসিংদী সফরকালে জামেয়ার উন্নয়নে তিন লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেন। এ অর্থ দ্বারা জামেয়ার ভবন নির্মানের কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। ৫ এপ্রিলের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার জনাব মোঃ নুরুজ্জামান। বক্তব্য রাখেন সর্ব জনাব আবুল হাই সরকার (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ঢাকা) নরসিংদী মহকুমা প্রশাসক জনাব মকবুল হোসেন, মাদ্রাসার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক আঃ রাজ্জাক লস্কর প্রমুখ।
¬প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার সাহেবের জামেয়া আগমন:
১৯৮২ সালের ১৪ জানুয়ারী শুক্রবার জামেয়ার ৬ষ্ঠ বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ধর্মপ্রাণ সহস্র জনতার উপস্থিতিতে তিনি সফরকালে জামেয়া ছাত্রাবাসের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি জামেয়ার বিজ্ঞান বিভাগ পরিদর্শন করেন। মহামান্য প্রেসিডেন্ট জামেয়ায় পৌছলে জামেয়ার ছাত্ররা তাকে “গার্ড অব অনার” প্রদান করে।
খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমেন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জামেয়ার ৬ষ্ঠ বার্ষিক সম্মেলনে অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বিচারপতি টি. এইচ. খান ও সৌদী রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খাতিব।
যাদের কাছে জামেয়া অনেক ঋণী:
জামেয়া কাসেমিয়া আজ যে গৌরবের আসনে আসীন তা একদিনে কিংবা একক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়নি। এর পেছনে অনেক অনেক মানুষের চিন্তাচেতনা যেমন কাজ করেছে, তেমনি অনেকের উৎসাহ উদ্দীপনা, অনেকের শ্রম আর অর্থ অনুদান জামেয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে এগিয়ে নিয়েছে বৃহত্তর পরিমন্ডলে। এ মূহুর্তে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়।
প্রথমত: সৌদী রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিব:
জামেয়া প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে তৎকালীন সৌদী রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিব জামেয়ার সাথে সব সময় ঘনিষ্টভাবে মিশে আছেন। জামেয়ার প্রতিষ্ঠাকালে তার অবদান বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে জামেয়ার পরিচিত স¤প্রসারণেও বিভিন্ন সহযোগিতা প্রাপ্তিতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
দ্বিতীয়ত: আসাবুদ্দিন ভূঁইয়া (মধু ভূঁইয়া): জামেয়ার নিকটবর্তী পুরান পাড়া নিবাসী শিল্পপতি সমাজ সেবক জনাব আসাবুদ্দীন ভূঁইয়া (মধু ভূঁইয়া) কে বার বার মনে পড়ে আমাদের। তিনি সর্বপ্রথম জামেয়া প্রতিষ্ঠার জন্যে ১০ গন্ডা জমি ওয়াক্ফ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি আরো সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে রেখেছিলেন। আমৃত্যু তিনি জামেয়ার ঘনিষ্ঠজনের একজন ছিলেন। সত্যিকারার্থে মধু ভূঁইয়া পরিবারের সদস্যবৃন্দ জামেয়ার সাথে সবসময় সম্পৃক্ত।
তৃতীয়ত: মৌঃ তাফাজ্জল হোসাইন: নরসিংদী জেলার বিশিষ্ট শিল্পপতি সমাজ হিতৈষী জনাব মৌঃ তাফাজ্জল হোসাইন জামেয়াকে সেবা দিয়ে গেছেন। অনেকদিন তিনি জামেয়া পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারী ছিলেন। মাঝে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া সবসময় তার মননে জামেয়ার উন্নতি আর সমৃদ্ধির চিন্তা ঘুরপাক খেত। জামেয়া এমন একজন নিবেদিত প্রাণ বন্ধুকে হারিয়ে সর্বদা তার অভাব অনুভব করে।
চতুর্থত: আলহাজ্ব আবেদ আলী মিয়া: জামেয়ার প্রতিষ্ঠার পর যে কজন নিবেদিত প্রাণ মানুষের দেখা মেলে তাদের মধ্যে আলহাজ্ব আবেদ আলী মিয়া অন্যতম। জামেয়া যখনই তার কাছে কোন প্রত্যাশা করেছে তখনই তিনি সহযোগিতার হাতকে বাড়িয়ে দিয়েছেন জামেয়ার দিকে। তাঁর উত্তরসূরী বর্তমানে আবেদ টেক্্রটাইল মিলস্ এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মন্জুর এলাহী তাঁর পিতার ভূমিকাকে উজ্জল করে রাখার জন্যে সব সময় সচেষ্ট রয়েছেন। বর্তমানে পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।
পঞ্চমত: জয়নাল আবেদিন তোতা মিয়া: জয়নাল আবেদীন তোতা মিয়া এই মানুষটিকে আল্লাহ জান্নাত নসিব করুন। জামেয়ার প্রতিষ্ঠাকালীন স্মৃতির সাথে মরহুম তোতা মিয়ার স্মৃতি বিজড়িত। কী আক্লান্ত পরিশ্রম যে তিনি করেছিলেন তা আজো আ¤øান।
ষষ্ঠতঃ শিল্পপতি আজাদ: গাওছিয়া মার্কেটের মালিক শিল্পপতি আজাদ সাহেবের অবদান আজ জামেয়ার ইতিহাসে অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তার অবারিত দান জামেয়ার অবকাঠামোতে এনেছে গুণগত পরিবর্তন। বর্তমান জামেয়ার মসজিদ কমপ্লেক্স, ইয়াতিম খানাসহ মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নে তিনি সব সময় ছিলেন অকৃপণ।
সপ্তমত: এম, আজিজুর রহমান: নারায়ণগঞ্জে বিশিষ্ট শিল্পপতি এম আজিজুর রহমান জামেয়ার সাথে গভীর আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি ৪ তলা বিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক ছাত্রাবাস ও ৬ তলা বিশিষ্ট মহিলা শাখা নির্মাণের যাবতীয় খরচ বহন করেছেন। ভবিষ্যতে জামেয়া তাঁর পরিবার থেকে প্রতিদানহীন সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।
জামেয়া পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন:
ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কাসেমিয়া প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তি বিভিন্ন সময়ে জামেয়ার পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হাকীম রুস্তম আলী আশরাফী, আলহাজ্ব মোঃ তাফাজ্জল হোসাইন, মোঃ আছহাব উদ্দিন ভূইয়া (মধু ভূঁইয়া), আব্দুর রহমান ভূঁইয়া, সমসের আলী ইঞ্জিনিয়ার, তোতা মিয়া, হাজী আবেদ আলী মিয়া, তাইয়্যেব উদ্দিন ভূঁইয়া, রুহুল আমিন, জোবেদ আলী ভূঁইয়া, খলিলুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ।
জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ: সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী:
জামেয়া কাসেমিয়ার আজ যে পরিচয় বহন করে চলছে, তার পেছনে মুখ্য ভুমিকায় রেখেছেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আলেমে দ্বীন আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বক্তা মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী। যার রয়েছে জাতীয় পর্যায় পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক পরিমÐলে ব্যাপক পরিচিতি। বিশেষ করে বিশ্ব বিখ্যাত ওলামায়ে কেরামের মাঝে তিনি একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। বিচক্ষন আর দূরদৃষ্টিসম্পুন্ন এই মানুষটির আদি বসতি দ্বীপাঞ্জল ভোলায়। তিনি ১৯৪৫ সালে ৩ মার্চ জন্মগ্রহন করেন । জনাব জাফরী ছাত্র জীবনের এক পর্যায়ে কুমরাদি সিনিয়র মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন।  ছাত্র জীবন শেষে কিছুদিনের জন্য দুর্বাটি আলিয়ায় শিক্ষকতা করেছিলেন। এক সময় তিনি ডাক পেলেন নরসিংদীর এলাকার মানুষের কাছ থেকে। ইতোমধ্যে তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে অত্র এলাকায় পরিচিত অর্জন করেন। সেই সুবাদে তাঁর প্রতি মানুষের আকক্সক্ষা একটু বেশি ছিল। তিনি ১৯৭৬ সালের এক মাহেন্দ্রক্ষণে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন জামেয়া প্রতিষ্ঠার। এরপর উচ্চ শিক্ষার্থে সৌদি আরব গমন করেন। মক্কা উম্মুলকুরা ইউনির্ভাসিটি থেকে ‘লিসান্স ইন এ্যারাবিক’ এ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তার কৃতিত্ব ও যোগ্যতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সৌদি বেতারে তখন তিনি নিয়মিত আলোচক ছিলেন। বিদেশে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে তিনি সমন্বয় করে জামেয়াকে একটা আদর্শ প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। দেশে ফিরে এলেন এক সময়। নতুন উদ্যোমে শুরু করলেন জামেয়ার কার্যক্রম, আর পেছন ফিরে তাকাননি তিনি। স্বপ্ন, জাগরণ, আশা কল্পনা সবই তার আবর্তিত হতে লাগল জামেয়াকে ঘিরে। যার ফলশ্রæতিতে আজ জামেয়া পরিণত হয়েছে বিশাল এক প্রতিষ্ঠানরূপে। তিনি এখন ভাবছেন জামেয়াকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করার কথা। জনাব জাফরী নানা সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত আছেন। বাংলাদেশে সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তনে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জামেয়ার উপাধ্যক্ষবৃন্দ:
জামেয়া কাসেমিয়া, নরসিংদীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত চারজন উপাধ্যক্ষ বিভিন্ন সময়ে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। যাঁদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় জামেয়ার শ্রেণীর কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য তৎপরতা সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। এই মাহিন্দ্রক্ষণে তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে তুলে ধরা আবশ্যক মনে করছি।
প্রথমত: হাফেজ মোঃ ফায়জুল­াহ (বড় হুজুর): জামেয়ার বড় হুজুর নামে প্রসিদ্ধ হযরত মাওলানা হাফেহ মোঃ ফয়জুল্লাহ জামেয়ার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৯১ সালের আগস্ট পর্যন্ত উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান তৎকালীন বৃহত্তর ঢাকা জেলার (বর্তমান গাজীপুর) কালীগঞ্জ থানার চর ছৈলানী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোঃ নাসিরুদ্দীন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কেটেছে গ্রামের স্কুলে। তারপর ঢাকা বড় কাটরা মাদ্রাসায় হেফজ চর্চা শুরু করেন। সেখান থেকে চলে যান কলকাতা। যুক্ত প্রদেশের বাইরাইচ শহরের নুরুল উলুম মাদ্রাসায় হেফজ শেষ করে দরসে নেজামী লাইনে লেখাপড়া করেন। দাওরায়ে হাদীস শেষ করে কুমরাদী মাদ্রাসায় আলিম ক্লাশে ভর্তি হন। সে সময় দাখিল ছিল না। আলিমে তিনি ১৩ নম্বর স্ট্যান্ড এবং ফাজিল পরীক্ষায় (কুমরাদী থেকে) চার নম্বর স্ট্যান্ড করেন। কামেল সম্পন্ন করেন ঢাকা আলিয়া (ল²ী বাজার) থেকে। কামেল পরীক্ষায় তিনি মেধা তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। মোহ্তারাম ফায়জুল্লাহর কর্মজীবন শুরু হয় এলাকায় কামড়া দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বেতন ছিল মাত্র ৪০/=টাকা। সুপার পদে এখানে তিনি দায়িত্ব পালন করতেন। জামেয়ার প্রস্তুতি পর্ব থেকেই তিনি এর সাথে জড়িত ছিলেন। জামেয়া তাঁর কাছে অনেক ঋণী। জামেয়ার প্রতিটি ইটের সাথে যেন মিশে আছে জনাব ফায়জুল্লাহর স্মৃতি আর হাতের ছোঁয়া।
দ্বিতীয়ত: আবু তৈয়ব মোঃ রফিউদ্দীন: জনাব আবু তৈয়ব মোঃ রফিউদ্দীন জামেয়ার সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৫ জুন ৯০ তে যোগদান করেন। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ হতে ৩১ জানুয়ারী ১৯৯৩ পর্যন্ত জামেয়ার উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জনাব রফিউদ্দীন মনোহরদী উপজেলার শেখেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী আজিমুদ্দীন। তিনি ১৯৬৯, ৭১, ৭৩ সালে যথাক্রমে দাখিল, আলিম ও ফাযিল পাশ করেন। ১৯৯২ সালে জামেয়া কাসেমিয়ার পরীক্ষার্থী হিসেবে কামিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২য় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। তার বিশেষ কৃতিত্ব হচ্ছে জেনারেল লাইনেও তিনি বি, এড, ডিগ্রী অর্জন করেন (২০০১)।
তৃতীয়ত: আ, ন, ম, রফীকুর রহমান আল মাদানী: একজন সফল শিক্ষক এবং একজন সুযোগ্য উপাধ্যক্ষ হিসেবে আ,ন,ম, রফীকুর রহমান আল মাদানীর নাম জামেয়ার প্রাক্তন ছাত্র-শিক্ষক সবার মুখে মুখে আজো উচ্চারিত হয়। শিক্ষা জীবনে গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বের অধিকারী তিনি প্রতিটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় গৌরবময় রেজাল্ট করেন। তিনি এম, এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট (ঢাকা বিদ্যালয়), লিসান্স ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় (ট্রেইন্ড)। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচারিত মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করেন। সৌদি আরবের নিযুক্ত দায়ী হিসেবে রফীকুর রহমান (মাদানী হুজুর) জামেয়ায় পদার্পন করেন। ১৯৯৩ সালের ১ ফেরুয়ারী থেকে তিনি জামেয়ার উপাধ্যক্ষ হিসেবে নতুন দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। সেখান থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একটানা ১৯৯৭ সালের ৪ মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন । বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান পদে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসের সাথে তিনি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত আছেন।
চতুর্থত: মাহমুদুল হাসান আল মাদানী: জামেয়া কাসেমিয়া নরসিংদী চতুর্থ উপাধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৯৮ সালের ৫ই মে থেকে হয়ে আজ অবধি কর্মরত আছেন প্রখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা মহমুদুল হাসান আল মাদানী। লক্ষীপুর জেলার রামগতি থানাধীন চরসীতা গ্রামে ১৯৬৩ সালেন ১ ফেব্রুয়ারী জনাব হাসান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দাখিল পরীক্ষায় (১৯৭২) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২য় স্থান, আলিম পরীক্ষায় (১৯৭৪) ১ম স্থান, ফাজিল পরীক্ষায় (১৯৭৬) ১ম স্থান এবং কামিল পরীক্ষায় (১৯৭৮) ৪র্থ স্থান লাভ করেন। তিনি দাখিল আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় অংশনেন ল²ীপুর জেলার চরকলাকোপা কারামাতিয়া মাদ্রাসা থেকে। আর কামিল পরীক্ষায় অংশ নেন নোয়াখালী কারামতিয়া মাদ্রাসা থেকে। তিনি ১৯৭৯ইং সনে সৌদী সরকারের স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় গমন করেন এবং আল কোরআন অনুষদ থেকে প্রথম বিভাগে লিসান্স (১৯৮৫ইং) ও তাফসীর বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স (১৯৮৮ ইং) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মোহতারাম মাহমুদুল হাসান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার লেখা আরবী এবং বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বার্ষিকী, সামায়িকী ও মাসিক পত্রিকায় প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
জামেয়ার বিভিন্ন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার প্রথম পরীক্ষার্থীবৃন্দ:
জামেয়া কাসেমিয়া, নরসিংদী হতে ১৯৭৯ সালে মাত্র ২জন ছাত্র দাখিল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। তারা হলেন হাফেজ এরশাদুল্লাহ (৬ষ্ঠ স্থান) এবং মাহবুবে এলাহী (২য় বিভাগ)। ১৯৮২ সালে প্রথম বারের মত আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয় জামেয়ার ৪ জন পরীক্ষার্থী । যথাক্রমে তারেক মোঃ মনোয়ার, হফেজ আঃ ছালাম, মোঃ মাইনুদ্দীন ও মাহবুবেব এলাহী। ১৯৮৫ সালে ৮ জন পরীক্ষার্থী ১ম বারের মত ফাজিল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। তারা হলেন মোঃ রুহুল আমীন, (মেধা: ২য় স্থান) মোঃ আবুল ফজল হুসাইন আহমদ (মেধা: ৫ম স্থান), মোঃ জসিম উদ্দীন, মোঃ ইকবাল আহমদ, মোঃ ফারুক আহমদ, ওয়লিউর রহমান, মোঃ আতিকুল্লাহ এবং মোঃ ইউসুফ আলী। ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মত জামেয়ার ছাত্ররা কামিল পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মোট ১১ জন। তারা হলেন মোঃ আব্দুস সামাদ আজাদ, মোঃ সিরাজুল ইসলাম, মোঃ শওকত আলী, মোঃ নাজমুল হুদা সিরাজী, মোঃ ইউনুছ ফারুকী, আবু নাঈম, মোঃ সফিকুল হক এরা সবাই প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এছাড়া ২য় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন মোঃ মওদুদুর রহমান আতিকী, মোঃ মুজিবুর রহমান, হাঃ তাজুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান এবং মোঃ নুরুল হক পাটওয়ারী।
জামেয়া পরিদর্শনে দেশী বিদেশী মেহমানবৃন্দঃ
এ পর্যন্ত জামেয়া কাসেমিয়াতে দেশ বিদেশের অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। এর মধ্যে ফুয়াদ আঃ হামিদ আল খতীব (রাষ্ট্রদূত), ড. আব্দুল্লাহ মোছলেহ, আব্দুল বাকী আশশুরাইকী (সৌদি), ডঃ মাহের (সিরিয়া), ডঃ আদম (সুদানী), ডঃ রহমাতুল্লাহ নজির খান (সৌদি), শেখ মোঃ ইব্রাহিম বিন কাউদ, আহম্মদ আলী আর রুমী, আমহদ বাজী আল ইয়াছিন (কুয়েত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশীদের মধ্যে ১৯৭৮ সালে মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নরসিংদীর ইউ,এম,সি জুট মিলে আগমন করলে জনাব খানে আলম খান তাঁর সাথে জামেয়ার অধ্যক্ষসহ প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জামেয়ার বিশিষ্ট পৃষ্টপোষক খাদ্যমন্ত্রী জনাব আঃ মোমেন খান। এই মোমেন খানেরও অনেক অবদান রয়েছে জামেয়া বিকাশে। মহামান্য প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার (১৯৮২), আব্দুল মান্নান চেয়ারম্যান, মাদ্রাসা বোর্ড, বাকী বিল্লাহ (ঐ) মাওলানা আব্দুল খালেক (ইন্সপেক্টর, মাদ্রাসা বোর্ড), জনাব আঃ মালেক (ঐ), জনাব মাওঃ মাহবুবুর রহমান (ঐ), মাওলানা ইউনুস খান (চেয়ারম্যান, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড), মাওঃ আব্দুল আজিজ, জনাব মোখলেসুর রহমান (শিল্পপতি) প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আগমনে জামেয়া ক্যাম্পাস বার বার মুখরিত হয়েছে।
জামেয়ার সাহিত্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম:
একটি স্বাতন্ত্র্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জামেয়া কাসেমিয়ার শিক্ষার্থীরা সহপাঠ্য কার্যক্রম তথা সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বিশেষভাবে কৃতিত্ব প্রদর্শন করে আসছে। নিয়মিত ক্লাশের পাশাপাশি সাপ্তাহিক বিতর্ক, বক্তৃতা, হামদ-নাত, ইসলামী সঙ্গীত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জামেয়ার ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। জামেয়ার অঙ্গন পেরিয়ে থানা, জেলা, বিভাগ এমনকি জাতীয় পর্যায়ে অনেকবার জামেয়া কাসেমিয়ার ছাত্ররা পুরষ্কার লাভ করেছে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, যুব দিবস, মৌসুমী প্রতিযোগিতাসহ সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে আয়োজিত সব প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বরাবর ঈর্ষণীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করে জামেয়ার ছাত্ররা। জাতীয় গণমাধ্যমে জামেয়ার অধ্যক্ষ মাওলানা কামালুদ্দীন জাফরী, উপাধ্যক্ষ জনাব মাহমুদুল হাসান আল-মাদানী, প্রধান মোহাদ্দিস কাজী মোঃ ইব্রাহীম ও সাবেক উপাধ্যক্ষ আ,ন,ম, রফিকুর রহমান আল-মাদানী সাহেবের অংশ গ্রহন, এটি. এন. বাংলা ও পিস টিভিতে জামেয়ার প্রাক্তন ছাত্র তারেক মনোয়ার, শাহ ওয়ালিউল্যাহর উপস্থিতি, বাংলাদেশ বেতারে আবু তাহের বেলালের উপস্থাপনা ও তালিকাভুক্ত গীতিকার হবার কৃতিত্ব জামেয়ারই অবদান। জামেয়া ছাত্র সংসদের উদ্যোগে নিয়মিত দেয়ালিকা ও স্মরনিকা প্রকাশ করা হয়। এর মাধ্যমে অসংখ্য গীতিকার ও কমামিষ্ট জন্ম নিচ্ছে। যা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কল্পনাও করা যায় না। ফযজুল করীম  মনোয়ার, মহিবুল্লাহ, মাসুম জামান জুয়েল, হাবিবুল্লাহ কবীর, বাতেন, মাজহার, হাফেজ বেলাল,মারুফ আল্লাম, শামছুল ইসলাম, ফারুক হোসাইন গানের জগতে পরিচিত মুখ। নরসিংদী জেলায় উজ্জ্বীবন শিল্পী গোষ্ঠী মূলত জামেয়ার ছাত্রদের কন্ঠস্বরে সবসময় উচ্চকতি হয়। আর্টিস্ট হিসেবে সাইফুল ইসলাম, ফখরুদ্দীন, লুৎফর রহমান, ওয়ালিউল্যাহ, মঈনুল হক তানভীর, সৈকত, হাফেজ মিজানের নাম সবার মুখে মুখে ছিল। এছাড়া আরো অনেকে এখন সম্ভাবনাময়ী তুলী শিল্পী।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে জামেয়ার অবদান:
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ। এর রয়েছে একটি বিশাল বিস্তৃত সমৃদ্ধ ও কালজয়ী ঐতিহ্য, যা অনেকের মাঝে কিংবদন্তীর মতো মনে হয়। জামেয়ার প্রতি সেশনেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্রদের ভোটে যোগ্য নেতা বাছাই করা হয়। আজকের ছাত্ররাই আগমী দিনের নেতৃত্ব দিবে। তাই জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে জামেয়া কাসেমিয়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ১৯৭৮ সাল থেকে জামেয়া ছাত্র সংসদের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম ভি.পি হয়েছিলেন হাফেজ মোঃ এরশাদুল্লহ। প্রচারবিহীন ছাত্রসংসদ নির্বাচন গণতন্ত্র চর্চার এক অপূব দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যায়।
জামেয়া কাসেমিয়ার অন্যান্য বিভাগের কার্যক্রম:
জামেয়া কাসেমিয়া হেফজ বিভাগ: কোরআন শরীফ শিক্ষা করা অনেক বড় মর্যাদার কাজ। হাদীস শরীফে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, একজন সত্যিকার হাফেজ কিয়ামতের দিন তাঁর আতœীয় স্বজনদের মধ্যে এমন দশজন লোককে বেহেশতে নিতে পারবেন, যাদের জাহান্নামের ফয়সালা হয়ে গেছে। রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন, কেয়ামতের দিন হাফেজ সাহেবের মাথায় নূরের মুকুট পড়ানো হবে। এমনকি তাদের পিতা-মাতার মাথায়ও নুরের মুকুট পড়ানো হবে। জামেয়া কাসেমিয়া মাদ্রাসা হতে প্রতি বছর ভালো কয়েকজন হাফেজ সাহেব বের হচ্ছে এবং তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করে মাদ্রাসার সুনাম অক্ষুন্ন রাখছে।
এতিমখানা: জামেয়া কাসেমিয়া এতিমখানার গরীব ছাত্রদেরকে বিনামূল্যে পড়াশুনা ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এখানে এসে দেশের গরীব ছাত্ররা এলেম শিক্ষা করে মাদ্রাসার সুনাম সুখ্যাতি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।
ছাত্রাবাস: জামেয়া কাসেমিয়ায় রয়েছে বিশাল বিশাল কয়েকটি ছাত্রাবাস। যার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন বিভাগ থেকে এ মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে তাদের জীবনকে করে তুলেছে উজ্জ্বল। এক. মাওলানা আজিজুর রহমান (রাহঃ) ছাত্রাবাস, দুই. ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছাত্রাবাস, তিন. শহীদ হাসানুল বান্না ছাত্রাবাস, চার. ইমাম ইবনুল কায়্যেম ছাত্রাবাস মিলে মোট ৪৫০ জনের মত ছাত্র এখানে আবাসিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।
মহিলা বিভাগ: এখানে রয়েছে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের জ্ঞান দানের আলাদা বিভাগ। যার কারণে মেয়েরাও কোন দিকে পিছিয়ে নেই। এর কথা পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। ১ম শ্রেণী থেকে কামিল পর্যন্ত পৃথক ব্যবস্থাপনায় ছাত্রীদের পড়াশোনার মনোরম পরিবেশ এখানে বিদ্যমান।
মসজিদ কমপ্লেক্স: জামেয়া কাসেমিয়ার রয়েছে বায়তুল মুকাদ্দিস আকৃতি বিশিষ্ট বড় ও আকর্ষণীয় একটি মসজিদ। এখানে ছাত্ররা ও আশে পাশের জনগণ সালাত আদায় করেন। দ্বীনের বিভিন্ন দিকের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা এ মসজিদে শোনা যায়।
খেলাধুলায় জামেয়া কাসেমিয়ার অবদান: লেখাপড়ায় যেমন জামেয়ার অবদান শীর্ষস্থানে তেমনি খেলাধুলায় ও তারা এগিয়ে। প্রত্যেক বছর মাদ্রাসার ফাÐ থেকে টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন রকমের ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয় করা হয়। পড়াশুনা করতে হলে মনকে উৎফুল্ল রাখতে হয়। খেলাধুলায় তাদের মনকে উৎফুল্ল রাখে। তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় ও অংশ গ্রহণ করে সবার অগ্রে তাদের স্থান রাখছে। জামেয়া ফুটবল টিম প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে চমক সৃষ্টি করেছে। ফুটবল টিম ছাড়াও ক্রিকেট, হকি, হাতবল, ভবিবল ইত্যাদি এছাড়াও ছাত্রদেরকে আনন্দ দানের জন্যে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নিছক আনন্দ নয় বরং শারীরচর্চা হিসেবে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। যাতে করে শারীরিক দিক থেকে ও তারা সবল হয়ে উঠতে পারে। জামেয়ার ভলিবল ও ফুটবল টিম একাধিক জেলা চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছে।
শেষ কথা: জামেয়া কাসেমিয়া, নরসিংদী আজ এক গৌরবদীপ্ত প্রতিষ্ঠানের নাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগে জামেয়ার ছাত্ররা সমান ভাবে কৃতিত্ব প্রদর্শন করছে। জাতীয় দুর্যোগ ও সংকটে এখানকার ছাত্ররা এক তাৎপর্যপূণ অবদান রাখছে। জামেয়ার সামনে এখন একটাই চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ইন্শাআল্লাহ অচিরেই জামেয়া এ টার্গেটে পৌঁছতে সক্ষম হবে। এজন্যে প্রয়োজন সবার সহযোগীতা ও আন্তরিকতা। আল্লাহ আমাদের সবার সৎ উদ্দেশ্য কবুল করুন। আমীন।
লেখক পরিচিতি: আবু তাহের বেলাল, প্রাক্তন ছাত্র। জামেয়ায় অধ্যয়ন কাল (১৯৮৬ থেকে ১৯৯২) বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক, স্ক্রীপ্ট রাইটার ও তালিকাভুক্ত গীতিকার, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি- ন্যাশনাল কলেজ অব এডুকেশন, নরসিংদী।

Location
  • No comments yet.
  • Add a review